এম এ জুহাইর (চট্টগ্রাম)
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে একদফার চলমান আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটি এখন রাজপথেই সংকটের সমাধান খুঁজবে। আন্দোলন জোরদারে নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে তারা। এর অংশ হিসেবে যুগপতের বাইরে থাকা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে নেই, কিন্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়—এমন বিভিন্ন দল ও জোট যাতে নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে সমন্বিতভাবে একই কর্মসূচি ঘোষণা ও পালন করে, তপশিলের পরিপ্রেক্ষিতে এখন এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে চায় বিএনপি। চলমান আলোচনায় খুব শিগগির একটা মতৈক্যে পৌঁছানোর আশা দলটির। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে যুগপতের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোও যাতে একই পথ অনুসরণ করে, সে ব্যাপারেও তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্যকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ঘোষিত তপশিলে মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই-বাছাই, প্রত্যাহার ও প্রতীক বরাদ্দ এবং প্রচার অর্থাৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে শক্তভাবে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও যুগপতে থাকা মিত্ররা। ‘একতরফা’ তপশিলে নির্বাচনে না যাওয়ার অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান আন্দোলন টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা একমত হয়েছেন। এর মধ্যে যদি পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন না হয় কিংবা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো লক্ষণ প্রতীয়মান না হয়, তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কারা নির্বাচনে যাচ্ছে, সেটা দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোট ঠেকাতে লাগাতার কর্মসূচিতে যেতে পারে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা।
এদিকে ‘একতরফা’ তপশিলের প্রতিবাদ এবং একদফার চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ রোববার থেকে বিএনপি ও যুগপতের শরিকদের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টা হরতালের কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা আগামী মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত চলবে। জানা গেছে, এই হরতাল শেষে এক দিন বিরতি দিয়ে চলতি সপ্তাহের শেষ দুদিন ফের হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। এরপর জনস্বার্থে শুক্র ও শনিবার বিরতি দিয়ে আগামী সপ্তাহ থেকে দেশব্যাপী ফের অবরোধের কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি ও শরিকরা। এর আগে একদফা দাবিতে গত ২৯ জুলাই থেকে পাঁচ দফায় সারা দেশে ১১ দিন অবরোধ এবং এক দিন হরতালের কর্মসূচি পালন করেছে।
বিএনপি ও যুগপৎ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে এসব কর্মসূচি কীভাবে যুগপৎ ও যুগপতের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। জানা গেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে পৃথকভাবে আন্দোলন করছে পাঁচ দলের মোর্চা বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং পাঁচটি ইসলামী দলের মোর্চা ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’। অন্যদিকে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’র জোটে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বদরুদ্দোজা আহমেদ-কাজী আবুল খায়ের) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন রয়েছে। এর মধ্যে চারটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এক সময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা জোট থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, বাম গণতান্ত্রিক জোটে দুটি নিবন্ধিত দল রয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। এ ছাড়া চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একদফার আন্দোলনে নামে দলটি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিসহ আটটি দল নিবন্ধিত। বাকি সাতটি দল ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের বাইরে নিবন্ধিত অন্য দলগুলো যাতে বর্তমান তপশিলে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যায়, সেজন্য দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করছে বিএনপি ও যুগপতের মিত্ররা। বাম গণতান্ত্রিক জোট, ‘সমমনা ইসলাম দলগুলো’ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাদের ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন কালবেলাকে বলেন, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে একতরফা একটি তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষার কোনো মিল নেই। কারণ, জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই কারণে আমরা এই একতরফা তপশিলকে প্রত্যাখ্যান করেছি। জনগণ এই তপশিল মানে না। একতরফা তপশিল ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে জনগণ ইতোমধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এটিকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে নবতর পর্যায়ে নিয়ে আমরা এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করব এবং একতরফা নির্বাচন আমরা প্রতিহত করব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘোষিত তপশিলে এই সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না। যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা নিবন্ধিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ ইতোমধ্যে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত ইসলামী কয়েকটি দলসহ অন্য যেসব দল আছে, তারাও যাতে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যায়, সেজন্য আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় ও যোগাযোগ করছি। আমাদের চলমান সরকারবিরোধী ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পরিধি আরও বৃদ্ধি করে সবাইকে আন্দোলনে শরিক করার চেষ্টা করছি।