শ্রমিক লীগের ভোল পাল্টে শ্রমিক দলের ব্যানারে চালাচ্ছেন লুটতরাজ!

যমুনা অয়েল কোম্পানি লুটে খাচ্ছে ইয়াকুব!

ইয়াকুবের ঘরে আলাদিনের চেরাগ, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর আড়াই কোটির ফ্ল্যাট!

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বিশেষ প্রতিনিধি।

যমুনা অয়েল কোম্পানি লুটে খাচ্ছে প্রতিষ্টানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী তেল সেক্টরের মাফিয়া ইয়াকুব । শ্রমিক লীগের ভোল পাল্টে শ্রমিক দলের ব্যানারে চালাচ্ছেন লুটতরাজ।

থেমে নাই প্রতিষ্ঠানের আওয়ামীলীগ সমর্থিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য। তেল পাচার ও চুরির দায়ে একাধিক কর্মকর্তার হয়েছে শাস্তি ও জরিমানা। অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় কেউ কেউ ফেরত দিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। কাউকে গুরু অপরাধে দেওয়া হয়েছে লঘু দন্ড। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েলে এসব কুকর্ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ওপরের কর্মকর্তারা এসব অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। এতে সুনাম নষ্ট হচ্ছে যমুনা অয়েলের। সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তারা হচ্ছেন হতাশ-কোণঠাসা।

রাষ্ট্রায়ত্ত যমুনা অয়েল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী মো. ইয়াকুব তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। একই সঙ্গে তিনি শ্রমিক লীগ নেতাও। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর থেকে শুরু করে এখনো  সিবিএর সাধারণ সম্পাদক  দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জ্বালানি তেল খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের মহাসচিবের দায়িত্বও সামলাচ্ছেন।

গত বছরের (বুধবার) ২ অক্টোবর যমুনা ভবনের  সামনে তেল সেক্টরের  দুর্নীতিবাজ কর্মচারী মাফিয়া মো. ইয়াকুবের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।একপর্যায়ে মানববন্ধনের ওপর হামলা ঘটনাও ঘটে। এতে বক্তব্য দেন শাকিল, মো. হানিফ, মো. শফি, পারভেজ প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ফ্যাসিবাদের দোসর চট্টগ্রামে যমুনা অয়েলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াকুব ১৬ বছর ধরে জিম্মি করে রেখেছেন। ইয়াকুবের বিলাসবহুল বাড়ি, দামি গাড়ি, জমিসহ বহু সম্পত্তি রয়েছে। তিনি এখন বহু টাকার মালিক। তাঁর বিরুদ্ধে যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্টর ক্যাজুয়াল নিয়োগ, ফার্নেস অয়েল, বিটুমিনসহ বিভিন্ন খাতে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ নেওয়ার অভিযোগ তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।

যমুনা অয়েল কোম্পানি লেবার ইউনিয়ন (সিবি-এ) (রেজি নং বি-১৭৩৬) প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে । কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপি’র অঙ্গসংগঠনের ব্যানারে নির্বাচন হয়। ফলে বিগত ১৬ বছর দলের প্রভাব খাটিয়ে কোন ধরনের বাধা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়ায় শ্রমিক লীগের ব্যানারে নির্বাচনে লেবার ইউনিয়নের  টানা অষ্টম বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন এয়াকুব। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি তাকে।

আরও পড়ুন  নগর থেকে চুরি মোটরসাইকেল কক্সবাজারে উদ্ধার

দাপটের সাথে নানান অনিয়মের মাধ্যমে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লুটেপুটে খেয়ে যাচ্ছেন সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইয়াকুব। অভিযোগ রয়েছে,  বর্তমানে প্রায় শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক তিনি।

গত বছরে ৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও এই শ্রমিক লীগ নেতা মো. ইয়াকুব রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তার ঘরেই রয়েছে আলাদিনের চেরাগ। ইয়াকুব এখন শ্রমিক লীগের ভোল পাল্টে  শ্রমিক দলের ব্যানারে চালাচ্ছেন লুটতরাজ।

চলিত বছরের পহেলা মার্চ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী অন্তর্গত ব্যানারে অবৈধ টাকার জোরে তার ক্যারিশমেটিকের মাধ্যমে যমুনা অয়েল কোম্পানি লেবার ইউনিয়ন (সিবি-এ) (রেজি নং বি-১৭৩৬)  দ্বি-বার্ষিক কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনে ইতিহাসে টানা নবম বারের মত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।

এই নিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করলেও তেল সেক্টরে এত বড় মাফিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না কেউ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, ভেবেছিলাম যমুনা অয়েল কোম্পানিতে ইয়াকুব যুগের অবসান হবে। কিন্তু তা হয়নি, তার অবৈধ টাকার মিছিলে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও নতজান।  যমুনা অয়েল কোম্পানি এখনো আওয়ামী লীগের কব্জায় রয়েছে যার ফলশ্রুতিতে ইয়াকুব বারবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।তিনি কোন সময়ে শ্রমিকদের কল্যাণে কিছুই করেনি বরং নিজের আখের বোঝাতে ব্যস্ত তিনি।

দেশের যেসব স্থানে উড়োজাহাজে যাওয়া যায়, সেসব স্থানে গেলে ইয়াকুব সাধারণত উড়োজাহাজেই চড়েন। বিদেশে ট্যুরও করেন হরহামেশা। মাসিক ৩৪ হাজার টাকা বেতন জ্যেষ্ঠ সহকারী মো. ইয়াকুবের। কিন্তু স্যালারি অ্যাকাউন্টে পৌনে ৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ব্যাংক এশিয়া কর্তৃপক্ষ তাঁর হিসাবটিকে সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লেনদেন (এসটিআর) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর ইয়াকুব থাকেন ৪ হাজার ৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে; যার মূল্য ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বেশি।

যমুনা অয়েল কোম্পানি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানিতে অস্থায়ী পদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে চাকরি শুরু করেন ইয়াকুব। তিন বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানের টাইপিস্ট পদে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আরও পড়ুন  দখলে ছোট হচ্ছে গুমাইবিল পদক্ষেপ নিবে বেলা

এদিকে ইয়াকুবের অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৪ সালেও একবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তাঁর এসব অপকর্মের তদন্ত শুরু করেছিল; কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা চাপা পড়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, ইয়াকুবের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রধান তেল স্থাপনা ও দেশের সব ডিপো থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায়েরও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তাঁর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বদলিসহ নানা রকম শাস্তি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ করেছেন একাধিক কর্মচারী।

ইয়াকুবের মতের বাইরের লোকজনের চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে। সূত্র জানায়, ইয়াকুবের সহকর্মী বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ইফতেখার কামাল খান ও মো. কামরুজ্জামান লিটনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাঁদের মধ্যে কামরুজ্জামান লিটন মারা গেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকা লালখান বাজার ৩৩, হাই লেভেল রোডে (মানারাত ইদ্রিস প্যালেস) চার হাজার ৩০০ বর্গফুটের তিনটি ফ্ল্যাট কেনেন ইয়াকুব। পরে তিনটি ফ্ল্যাটকে একটি বানিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।

মানারাত ইদ্রিস প্যালেস নির্মাণকারী মানারাত অ্যাসেট লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, এ প্রজেক্টে ইয়াকুব সাহেব যে ফ্ল্যাট কিনেছেন তার তিনটিকে একটি করা হয়েছে। এখানে মোট ৪ হাজার ৩০০ বর্গফুট। ফ্ল্যাটটি মারিয়া সুলতানা হ্যাপির কাছ থেকে কিনেছেন তিনি।

আরও জানান, বর্তমানে এই এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের মূল্য ৬ হাজার টাকার বেশি। সে হিসাবে ইয়াকুবের ফ্ল্যাটটির মূল্য আড়াই কোটি টাকার বেশি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফ্ল্যাট ছাড়াও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে ইয়াকুবের ২ গন্ডা জমিতে টিনশেডের ঘর আছে। পতেঙ্গায়ও ৩ গন্ডা জমি আছে। আর গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীর বেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন স্থানে ইয়াকুবের নামে-বেনামে জমি রয়েছে।

যমুনা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় ১২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে ইয়াকুবের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন  বন্দর থানা পুলিশের অভিযানে ২টি চোরাই মোটর সাইকেল উদ্ধার:আটক ৪

অভিযোগ উঠেছে, যমুনা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদারের শ্রমিক মো. আবদুল নুর ও মো. হাসান ফয়সালের সহযোগিতায় সিবিএ নেতা ইয়াকুব ২০১৯ সালে কোম্পানির ডিপোতে চাকরি দেওয়ার নামে ৮ জনের কাছ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিকাশের মাধ্যমে কয়েক দফায় ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা নিয়েছেন।

চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তোতা মিয়া ও চাকরিপ্রার্থীদের নানা ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ইয়াকুবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানায় ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই সাধারণ ডায়েরি করেন মো. তোতা মিয়া।

দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর পরিচালক বলেন, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইয়াকুবের বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

অভিযুক্ত মো. ইয়াকুবকে মোট ফোনে ও এসএমএস দিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে আগ্রাবাদ যমুনা অয়েল ভবনে গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: যমুনা অয়েল কোম্পানি দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ইয়াকুবের প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। শীঘ্রই অনিয়ম দুর্নীতির দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান  পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানি অপারেশন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতির খতিয়ান প্রকাশ করা হবে চোখ রাখুন সাপ্তাহিক  “পূর্বধারা ” পত্রিকায়।)

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন