বিশ্বের সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশে হরমুজ প্রণালী মাত্র ৪০ কিলোমিটার প্রশস্ত যেখান দিয়ে পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অপরিশোধিত তেল পারাপার হয়। মার্কিন হামলার পর এটি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ এর পরপরই রোববার (২২ জুন) এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
দেশটির পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য ও রেভোলিউশনারি গার্ডস কমান্ডার ইসমাইল কাওসারি আল-আরাবিয়া এবং জেরুজালেম পোস্টকে বলেন, ‘পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা উচিত। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ।’
বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহের গুরত্বপূর্ণ এই হরমুজ প্রণালী ইরান বন্ধ করলে বিশ্বে এর প্রভাব কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
হরমুজ প্রণালী দিয়ে কী পরিমাণে তেল যায়?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) অনুমান, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রতি বছর সমুদ্রপথে পরিবহন করা প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের জ্বালানি বাণিজ্যের সমতুল্য এটি।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে দেরি হতে পারে এবং এর তেলের দামের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এর আগে, বিশ্লেষকরা জানিয়েছিলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে আরও গুরুতর প্রভাব হিসেবে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
কীভাবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারে ইরান?
মার্কিন কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ইরান তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিতে পারে। সেই পদক্ষেপগুলোর তালিকায় রয়েছে—
লঙ্ঘনের পরিণতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করেই হরমুজ প্রণালীতে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
যাত্রীবাহী জাহাজ পরিদর্শন বা বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে বলে ঘোষণা করা।
সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করা।
প্রণালী এবং পারস্য উপসাগরে ন্যাভাল মাইন স্থাপন করা।
বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করতে সাবমেরিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরান তেল ট্যাংকারগুলোতে ‘সিল্কওয়ার্ম ক্ষেপণাস্ত্র’ মোতায়েন করার পাশাপাশি উপসাগরীয় জলসীমায় ন্যাভাল মাইন স্থাপন করেছিল।
এই মাইনগুলোর মধ্যে একটা ‘উএসএস স্যামুয়েল বি রবার্টস’ এ আঘাত হানে। এরপর মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে প্রতি মাসে জলপথে চলাচলকারী প্রায় তিন হাজারের মতো জাহাজকে থামানোর জন্য ইরান যেসব উপায়ের সাহায্য নিতে পারে, তারমধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ‘ফাস্ট অ্যাটাক বোট’ (দ্রুত আক্রমণকারী নৌযান) এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে মাইন মোতায়েন করে রাখা।
ইরানের নৌবাহিনী এবং ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর নৌবাহিনী বিদেশি যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তবে, বড় সামরিক জাহাজগুলো আবার ইসরায়েলি বা মার্কিন বিমান হামলার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ইরানের দ্রুতগামী নৌকাগুলোতে প্রায়শই জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকে। শুধু তাই নয়, ওই দেশ বিভিন্ন ধরনের ‘সার্ফেস ভেসেল’ (যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জলপৃষ্ঠের উপরে ব্যবহার করা যায়), আধা-নিমজ্জনযোগ্য জাহাজ এবং সাবমেরিনও পরিচালনা করে।
প্রণালী বন্ধ হলে কোন দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?
বিশ্লেষক সংস্থা ‘ভোরটেক্সা’র গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরব হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি করে, যা যেকোনো অন্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। এই প্রণালী ব্যবহার করে যে দেশগুলো অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলো চীন, ভারত, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া।
ইআইএ—এর অনুমান ২০২২ সালে হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া প্রায় ৮২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেলই (কম ঘনত্বের তরল হাইড্রোকার্বন যা সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে তৈরি হয়) পাঠানো হতো এশিয়ার দেশগুলোতে।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল, সে দেশে (দক্ষিণ কোরিয়ার) সরবরাহ হওয়া তেলের ৬০ শতাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে যায়।
ইআইএ জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন এই প্রণালী ব্যবহার করে প্রায় সাত লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেল আমদানি করে, যা তাদের মোট তেল আমদানির প্রায় ১১ শতাংশ এবং পেট্রোল ব্যবহারের ৩ শতাংশ।
হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে প্রতিদিন ইউরোপের সামগ্রিক তেলের ১০ লাখ ব্যারেলের কম বলে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে আরব ও এশীয় দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় শক্তির চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
হরমুজ প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া তেলের অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক হলো চীন। ইরানের তেলের প্রধান ভোক্তা হিসেবে বেইজিং কোনোভাবেই তেলের দাম বৃদ্ধি বা জাহাজ চলাচলের পথে কোনোরকম বাধাকে মানবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ‘এনার্জি করিডোর’ বন্ধ হওয়া আটকাতে চীন তার পূর্ণ কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করবে বলে আশা করা যেতে পারে।
জ্বালানি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আউটলুক অ্যাডভাইজার্সের অংশীদার আনাস আলহাজ্জি সিএনবিসিকে বলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে সম্ভবত ইরানের শত্রুদের চেয়ে তার মিত্রদেরই বেশি ক্ষতি হবে।
বিকল্প রুট?
বিভিন্ন সময়ে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকির কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল রফতানিকারক দেশগুলোকে একটা বিকল্প রফতানি রুট তৈরি করার উৎসাহ দিয়েছে।
ইআইএ —এর প্রতিবেদন অনুসারে, সৌদি আরব তার পূর্ব-পশ্চিম পাইপলাইন সক্রিয় করেছে। এই পাইপলাইন এক হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহন করতে পারে।
২০১৯ সালে সৌদি আরব সাময়িকভাবে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জন্য একটা প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পুনর্নির্মাণ করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত তার অভ্যন্তরীণ অয়েল ফিল্ডগুলোকে ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ বন্দরের সঙ্গে জুড়েছে। দৈনিক ১৫ লাখ ব্যারেল তেল এই পাইপলাইনের মাধ্যমে যেতে পারে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে ইরান ওমান উপসাগরে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের উদ্দেশ্যে গোরেহ-জাস্ক পাইপলাইন উদ্বোধন করে। এই পাইপলাইন দিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল তেল পরিবহন করতে পারে, যদিও প্রতিবেদন অনুসারে ইরান এখনো এই পাইপলাইন চালু করেনি।
ইআইএ-এর অনুমান অনুযায়ী, এই বিকল্প রুটগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ লাখ ব্যারেল তেল পরিচালনা করতে পারে। এই অংকটা বর্তমানে হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া অপরিশোধিত তেলের প্রায় ১৫ শতাংশ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
