চট্টগ্রাম বন্দর হবে আন্তর্জাতিক মানের, মালিকানা থাকবে বন্দর কতৃপক্ষের হাতেই

এনামুল হক রাশেদীঃ

★ ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান, দক্ষ নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে বন্দর। ★ ২০৩০ সালের মধ্যে সক্ষমতা ছয়গুণ বৃদ্ধি। ★ বে-টার্মিনাল, পাতেঙ্গা ও মাতারবাড়ি প্রকল্প এগোচ্ছে। ★ ১৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা।

বাংলাদেশকে আঞ্চলিক উৎপাদন ও লজিস্টিকস হাবে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ছয়গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে বন্দরটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বরং পূর্ব–দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম প্রধান লজিস্টিকস হাবে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছু কিছু মহল বন্দরের মালিকানা বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে যে ধূম্রজাল সৃষ্ঠি করেছে, এর জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো টার্মিনালের মালিকানা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক সভায় বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিণত করা। সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রথম শর্ত হলো চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি।

২০৩০ সালের মধ্যে সক্ষমতা ছয়গুণ বৃদ্ধিঃ বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা প্রায় ৩২ লাখ টিইইউ। ২০২৪ সালে এই বন্দরের মাধ্যমে দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয়। সরকারের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা বাড়িয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টিইইউ করার রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে রূপান্তর করা সম্ভব নয়।

অবকাঠামো নয়, পুরো লজিস্টিকস চেইনের উন্নয়নঃ প্রেস সচিব জানান, বন্দরের উন্নয়ন মানে কেবল যন্ত্রপাতি বাড়ানো নয়; বরং সড়ক, রেল, কাস্টমস, ট্র্যাকিং ও ডিজিটাল ব্যবস্থার সমন্বিত সংস্কার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্য খালাস যত দ্রুত হবে, বিদেশি বিনিয়োগ তত বাড়বে। বর্তমানে চট্টগ্রামে পণ্য জট গড়ে ৯–১১ দিন, যেখানে কলম্বোতে মাত্র ৩ দিন।

আরও পড়ুন  বাঁশখালী-টইটং-পেকুয়া-চকরিয়া সড়কচার লেনের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান

বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা ও মাতারবাড়ি প্রকল্প এগোচ্ছেঃ বন্দরের সম্প্রসারণে সরকার তিনটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, বে-টার্মিনাল তিন ধাপে বাস্তবায়নাধীন, এ পরিকল্পনা সম্পন্ন হলে বন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন শেষ পর্যায়ে; ২০২৫ সালে আংশিক চালু হবে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ২০২৬ সালে চালু হলে বৃহৎ জাহাজ নোঙর করতে পারবে।

১৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনাঃ বন্দর উন্নয়নে মোট ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বিনিয়োগে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP)–এর পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আগ্রহ দেখিয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বন্দরের দক্ষতা দ্বিগুণ হলে রপ্তানি আয় অন্তত ২৫ শতাংশ বাড়বে।”

সড়ক–রেল সংযোগই বড় চ্যালেঞ্জঃ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে গড়ে ৪৮ ঘণ্টা, যেখানে বন্দরের গেট থেকে ছাড়তে লাগে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। বিআইডিএস–এর গবেষণা অনুযায়ী, এই অদক্ষতা রপ্তানি ব্যয় ১১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। সরকার এখন ঢাকা–চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে ও চট্টগ্রাম–কক্সবাজার–মাতারবাড়ি মাল্টিমোডাল করিডোর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে।

ডিজিটাল পোর্ট সিস্টেম চালু হচ্ছেঃ অন্তর্বর্তী সরকার বন্দরের পুরো কার্যক্রমে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও অনলাইন ডকুমেন্টেশন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে পোর্ট কমিউনিটি সিস্টেম–এর ট্রায়াল শুরু করেছে, যেখানে আমদানি–রপ্তানিকারক, কাস্টমস ও ব্যাংক এক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকবে। এতে খালাস সময় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থানঃ বন্দর সম্প্রসারণের ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৫০ হাজার নতুন চাকরি তৈরি হবে এবং পরোক্ষভাবে দেড় লাখ মানুষ নতুন শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হবে। বর্তমানে প্রায় ৫,০০০ রপ্তানি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল।

দক্ষ নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে বন্দরঃ বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস.এম. মনিরুজ্জামান ও সচিব মো. ওমর ফারুক–এর নেতৃত্বে বন্দরের প্রতিটি বিভাগে দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসন বন্দরের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলছে।

আরও পড়ুন  বাঁশখালী সাধনপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস পালিত

পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন পোর্ট’ উদ্যোগঃ পরিবেশবিদদের মতে, বন্দর সম্প্রসারণে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক জোয়ার–ভাটার প্রবাহ বজায় রাখা জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বলেন, ‘অগ্রগতি যেন পরিবেশের ক্ষতির কারণ না হয়।’
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বে–টার্মিনালের প্রথম ধাপ ২০২৬ সালে, মাতারবাড়ি বন্দর ২০২৬ সালের শেষে চালু হবে।

আঞ্চলিক বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনাঃ বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, ২০৩০ সালের সক্ষমতা অর্জিত হলে বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ ও হালকা যন্ত্রাংশ রপ্তানিতেও আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বন্দরের দক্ষতা বাড়লে লজিস্টিকস খরচ জিডিপির ১৫% থেকে ৯%-এ নেমে আসবে, যা আন্তর্জাতিক মানের সমান।

রিজিওনাল হাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাঃ চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি বন্দর নয়—এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ফুসফুস। অন্তর্বর্তী সরকারের ছয়গুণ সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য যদি সময়মতো বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশ সত্যিই পৌঁছে যাবে তার ঘোষিত লক্ষ্যে,- ‘রিজিওনাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’-এর পথে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানা বিদেশিদের হাতে যাবে না: এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ছয়গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে যখন অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কিছু কিছু মহল বন্দরের মালিকানা বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে যে ধূম্রজাল সৃষ্ঠি করেছে, এর জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো টার্মিনালের মালিকানা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই।

রোববার (২৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বন্দর সচিব স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিছু গণমাধ্যম ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করে জনমনে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ সব টার্মিনাল, জেটি ও স্থাপনার মালিকানা এককভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের। শুধুমাত্র প্রচলিত বিধি অনুযায়ী লাইসেন্সধারী অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে, যা স্বচ্ছ ও জনবান্ধব।

বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ধারণাভিত্তিক ও অনির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচার বন্দরের কর্মপরিবেশ ও দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনে আরও পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।

আরও পড়ুন  ডি—লিট পেলেন ‘চবির ইউনূস

উল্লেখ্য, সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে—এমন খবরে রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলনে নেমেছে। নিরাপত্তার স্বার্থে সিএমপি বন্দর এলাকায় ৩০ দিনের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন