চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং জাতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। দিন দিন বাড়ছে রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম, কিন্তু বন্দরের ধারণক্ষমতা ও অবকাঠামো সেই তুলনায় বাড়েনি। ফলে জাহাজজট, কনটেইনার জট এবং লজিস্টিক ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের অন্যতম বড় উদ্যোগ হলো বে-টার্মিনাল প্রকল্প—যা বাস্তবায়িত হলে দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছে বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে। সম্প্রতি সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাইয়ের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানি (আইআইএফসি)-কে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শক নিয়োগে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা, নৌ-চ্যানেল, লজিস্টিক সুবিধা এবং টার্মিনালের অবস্থান নির্ধারণসহ ৩০ বছরের একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হবে।
বে-টার্মিনালটি গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে পতেঙ্গা থেকে পশ্চিমে, কর্ণফুলী নদীর মোহনা সংলগ্ন এলাকায়। প্রস্তাবিত এলাকায় প্রায় ১,০০০ একর জমি নিয়ে টার্মিনালের অবকাঠামো তৈরি হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এতে থাকবে, আধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল ও মালামাল হ্যান্ডলিং ইয়ার্ড।বৃহৎ জাহাজের জন্য গভীর পানির জেটি। ব্রেকওয়াল ও নেভিগেশন চ্যানেল। কাস্টমস, ওয়ারহাউজ ও ট্রাক পার্কিং কমপ্লেক্স। পৃথক রেল ও সড়ক সংযোগ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বে-টার্মিনাল চালু হলে একসঙ্গে ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৫–৬টি বড় জাহাজ নোঙর করতে পারবে, যা বর্তমান বন্দরের সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ।
বে-টার্মিনাল নির্মাণের মূল লক্ষ্য হলো, চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা। জাহাজজট নিরসন করে নৌ-পরিবহন কার্যক্রম দ্রুত করা। লজিস্টিক কার্যকারিতা ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়ানো। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ানো। ৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করে ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে কাঠামোবদ্ধ করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান ট্রানজিট হাবে পরিণত হবে। বৃহৎ জাহাজগুলো আর সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য যেতে হবে না। বন্দরের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৩৫ লাখ TEU থেকে বেড়ে প্রায় ৬০ লাখ TEU হবে। রপ্তানিকারকরা সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবেন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জন্য।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ, উপকূলীয় এলাকায় ভূমি উদ্ধার ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। পরিবেশগত ঝুঁকি, বিশেষ করে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের প্রভাব। পর্যাপ্ত সড়ক ও রেল সংযোগ না থাকলে টার্মিনালের কার্যকারিতা কমে যাবে। PPP মডেলে অর্থায়ন জটিলতা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হলে ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা।
বে-টার্মিনাল প্রকল্প সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনীতি যেমন গতিশীল হবে, তেমনি দেশের সার্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার বন্দর–নেটওয়ার্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে। পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে নতুন শিল্পাঞ্চল, গুদামঘর ও যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে উঠবে, যা নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।
চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় দ্বিগুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে, যা মোকাবেলায় বে-টার্মিনাল প্রকল্প হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হবে সফলতার চাবিকাঠি।
