লামায় ম্রো জনগোষ্ঠীর জায়গা দখলের অভিযোগে মানব বন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান

আফজাল হোসেন জয়, বান্দরবানঃ

পার্বত্যজেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার ২৮৫ নং সাঙ্গু মৌজার অংশ যুগ যুগ ধরে ম্রোদের জুমভূমি উ: উইচারা ভিক্ষু ও তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনুগংয়ের নেতৃত্বে ধর্মকে ঢাল করে বেআইনিভাবে দখল করার পাঁয়তারা, লামা উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রতিবাদে মানব বন্ধন এবং স্মারকলিপি প্রদান করেছেন ম্রো সম্প্রদায় জনসাধারন।

বুধবার (২৯ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১০টায় লামা উপজেলা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নস্থ সাঙ্গু মৌজার শত শত ম্রো জনগোষ্ঠী মানব বন্ধন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারকলিপিতে যা প্রকাশ করা হয়, ‘বিগত ১৯৯২ সালে আলীকদম ভরিরমুখ বিহার অধ্যক্ষ উঃ উইচারা ভান্তে’র আবেদনের প্রেক্ষিতে ম্যারাইনতং পাহাড়ে বুদ্ধ প্রতিবিম্ব, ভাবনা কেন্দ্র ও জাদী নির্মাণের জন্য মেরেঞ্জা পাহাড় বৌদ্ধ ধর্মীয় ধম্ম জাদী ও বিহারে নামে সাংগু মৌজা হতে পাঁচ একর জায়গা দান করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ম্যারাইনতং পাহাড় থেকে ম্রোদের উচ্ছেদ করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রিসোর্ট তৈরি জন্য উঃ উইচারা ভান্তে বেশ কয়েকবার ম্রোদেরকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য, হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও চাঁদা দাবি করে আসছে। ম্রো’রা চাঁদা না দেয়ায়, উ: উইচারা ভান্তে ও তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনুগংয়ের নেতৃত্বে আলীকদমের প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তিরা ২৮৫নং সাংগু মৌজায় সন্ত্রাসী তান্ডব চালায়।

গত ০৪/০৪/২০২৫ সাঙ্গু মৌজা হেডম্যান চংপাত স্রো এর নির্মিত ৩টি জুমঘর ভাঙছুর চালিয়ে ২১ লক্ষ টাকার মালামাল লুটপাট করে ও রিসোর্ট কেয়াটেকার হতে নগদ ১ লক্ষ ২ হাজার টাকা জোর পূর্বক ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনায় লামা থানায় অভিযোগ করা হয়। পরে বিগত ২৯ এপ্রিল/২৫ লামা উপজেলা নির্বাহী আদালতে একটি ফৌজদারী মামলা করা হয়।

মামলার পর ৫ ই মে লামা ও আলীকদম উপজেলার পুলিশ ও প্রশাসন সরেজমিন মারাইতং পাহাড়ে যৌথ তদন্তে গিয়ে ভাঙচুর লুটতরাজের ঘটনার সত্যতা,আলামত পান। ওইদিন প্রশাসন ১৪৪/১৪৫ ধারা জারী করেন এবং লামা-আলীকদম উপজেলা প্রশাসন যৌথ নির্দেশনা দিয়ে দুই পক্ষকে বিরোধীয় ভূমিতে নতুন করে কোনো কিছু নির্মাণ না করার নিষেধাজ্ঞা দেন।

আরও পড়ুন  পানছড়ির বন উজার বন্ধে ৩ বিজিবি-র নিয়মিত অভিযানে গোলকাঠ জব্দ ।

একই দিন বান্দরবান জেলা বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য সাচিংপ্রু জেরীর নির্দেশনায় বান্দরবান জেলা পরিষদ সদস্য খামলাই স্রো ও লামা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে যান। তারাও বিরোধপূর্ণ ভূমি পরিদর্শন করেন এবং মৌজা সীমানা চিহ্নিত করার আগ পর্যন্ত উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উ: উইচারা ভিক্ষু গং প্রশাসন ও বান্দরবানের সাবেক সাংসদ বিএনপি নেতা সাচিংপ্রু জেরীর মনোনীত নেতৃবৃন্দের নিষেধাজ্ঞাকে কর্ণপাত না করে, সাংগু মৌজার অংশে বিরোধীয় জায়গায় রাতারাতি অসম্পূর্ণ একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিস্থাপন করেন।

এই খবর জানার পর ২১ মে/২৫ সকাল আনুমানিক দশটার দিকে বান্দরবান জেলা পরিষদ সদস্য খামলাই ম্রো ও লামা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী পুনরায় সরেজমিন পরিদর্শনে যান। ওই সময় নেতৃবৃন্দ নালিশী ভূমিতে বুদ্ধমূর্তি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ২১ মে নেতৃবৃন্দ পরিদর্শন করে আসার দিনই বুদ্ধমূর্তিটিকে আঘাত করার স্পর্শকাতর ইস্যু বানিয়ে তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যানু বাদি হয়ে সাংগু মৌজা হেডম্যানসহ ১১ জনকে আসামী করে ২২ মে/২৫ আলীকদম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

অপরদিকে সাঙ্গু মৌজা হেডম্যানের করা মামলায় লামা উপজেলা নির্বাহী আদালত কর্তৃক মামলার নোটিশে ভূমিদস্যুগন প্রথম দফায় হাজির হলেও পরের তারিখগুলোতে হাজির হন নাই। মামলায় হাজির না হয়ে উ: উইচারা ভিক্ষুর ইন্ধনে ২৮৭নং তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনু মার্মা সাংগু মৌজার অংশে লাংকম ম্রো’র দখলীয় ৫ একর জায়গা তৈন মৌজার ১১৭ নং (গ্রোভ) হোল্ডিংয়ের অংশ দাবি করে, জবর দখলকারী হিসেবে হেডম্যানসহ সাংও মৌজার ১২জন অসহায় গরিব ম্রো’কে অভিযুক্ত করে আলীকদম থানায় আরেকটি পাল্টা মামলা করেন।

পরবর্তীতে মামলাটি বান্দরবান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিস সি আর ৬৬/২৫ মামলা হিসেবে রুজু হয়। আদালতের নির্দেশে মংক্যনু হেডম্যানের করা মামলাটি তদন্ত করে আলীকদম উপজেলা কানুনগো একটি প্রতিবেদন দেন। যার সারর্মম হচ্ছে, “নালিশী জমিটি অলীকদম উপজেলাধীন ২৮৭ নং তৈন মৌজা ও লামা উপজেলাধীন ২৮৫ নং সাঙ্গু মৌজা সীমান্তবর্তী মারাইনতং পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত। উক্ত নালিশী জায়গাটি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ দুই মৌজার সীমানা বিরোধ চলছে। এই নিয়ে পক্ষগণ ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে বিধায় নালিশী জমি দখল নিয়ে শান্তি ভঙ্গের আশংকা আছে। সরেজমিনে তদন্তে বিষয়ে পক্ষদ্বয়কে নোটিশের মাধ্যমে অবগত করা হলেও তদন্তকালে বাদী মংক্যনু হেডম্যান উপস্থিত ছিলেন না। বিবাদীগন, স্থানীয় লোকজনের বক্তব্যে এবং সরেজমিনে তদন্তে নিম্নস্বাক্ষরকারীর নিকট প্রতিয়মান হয়েছে যে, নালিশী জমি বাদীর দাবিকৃত ২৮৭ নং তৈন মৌজার গ্রোভ হোল্ডিং নং ১১৭ এর জমি নহে। উক্ত জমিটি সরকারি খাস জমি। জমিটি নিয়ে দুই মৌজার সীমানায় বিরোধ চলছে। নালিশী জমিটি পক্ষদ্বয়ের মধ্যে দখল দেওয়ার চেষ্টা করলে আইন শৃংখলা ভঙ্গের আশংকা আছে।”

আরও পড়ুন  পার্বত্য চট্টগ্রাম ওলামা পরিষদের চার নেতা বহিষ্কার

অপরদিকে গত ৩০ জুলাই লামা উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা সাঙ্গু মৌজা হেডম্যান চংপাত এর দায়ের করা মামলায় নিষেধাজ্ঞার আদেশে বলা হয়, “২য় পক্ষকে (উঃউইচারা ভিক্ষু গং) তাদের বন্দোবস্তকৃত জায়গা ছাড়া ১ম পক্ষের (চাংপাত ম্রো) নালিশি জমি ও সরকারী খাস জমিতে প্রবেশ বারিত করা হলো। সহকারী কমিশনার (ভূমি), লামা কে সরকারী খাস দখলীয় ভূমি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। সার্ভেয়ার ২য় পক্ষের ৫ একর ভূমি যা সাংগু মৌজাতে তা পরিমাপ করে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে মামলাটি নথিজাত করা হয়।”

এদিকে উ: উইচারা ভিক্ষু ও ২৮৭নং তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনু মার্মাগং আদালতে রায়কে অমান্য করে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে মারাইতং পাহাড়ে সাংগু মৌজার অংশে পর্যটন কটেজ পড হাউজ নির্মাণ ও তাবু টাঙ্গিয়ে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। এ সব বেআইনি কাজে ২৮৫নং সাংগু মৌজাবাসী, উ: উইচারা ভিক্ষু ও ২৮৭নং তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনুগংদের বাধা দিলে, তারা প্রাণ নাশের হুমকি, মিথ্যা মামলার ভয়ভীতি সহ মারাত্মক হুমকি দেয়।

সর্বশেষ গত ১৯ অক্টোবর বিকেলে লামা ও আলীকদম উপজেলা দুই নির্বাহী অফিসার, লামা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), লামা থানা অফিসার ইনচার্জ, আলীকদম উপজেলা কানুনগো মারাইতং পাহাড়ের দুই উপজেলাধীন মৌজার সীমানা পরিদর্শন করে সাংগু মৌজার অংশে উ: উইচারা গংয়ের দখলদারিত্বের সত্যতা পান।

এদিন উপজেলা প্রশাসন যৌথ তদন্তকালে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুর আলম তৈন মৌজার হেডম্যান ও সাংগু মৌজা হেডম্যানকে বিরোধপূর্ণ অংশে সীমানা নির্ধারণের পূর্বে বিরোধীয় ভূমিতে সকল কাজ বন্ধ রাখা, তাবু টাঙ্গিয়ে রাত্রি যাপন, বাইক পার্কিং, পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ লেনদেন সহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশ দেন এবং ২৮ অক্টোবর’ ২০২৫ ইং তারিখ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে ২ মৌজায় রেকর্ডভুক্ত দশ একর ভূমি পরিমাপ, মৌজা সীমানা পরিচিহ্নিত করার তারিখ ঘোষনা করেন।

আরও পড়ুন  বান্দরবানে ছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টা, জনতা বখাটেকে আটক করে পুলিশকে দিল

এদিকে ২৮ অক্টোবর’ মঙ্গলবার প্রশাসন কর্তৃক পরিচিহ্নিত কাজে বাধা দান করার উদ্দেশ্যে উ: উইচারা ভিক্ষু ও তৈন মৌজা হেডম্যান মংক্যনু মার্মা গং সকাল সাড়ে ৯ ঘটিকায় মারাইতং পাহাড়ের যাওয়ার পথে শিলবুনিয়াপাড়া নামক স্থানে মার্মা সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটান।

এ সময় তারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ও সম্প্রীতি বিনষ্টের উদ্দেশ্যে মনগড়া স্লোগান দেন। তারা বিভিন্ন উস্কানি মূলক মিথ্যা ও মনগড়া স্লোগান ফেস্টুন সহ মার্মা সম্প্রদায়ের শতাধিক মানুষকে প্রশাসনের কাজে বাঁধা প্রয়োগে রাস্তায় দাঁড় করিয়েছেন বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন।

ম্রো’রা স্মারকলিপিতে আরো উল্লেখ করেন, ”আমরা শান্তি প্রিয় সাংগু মৌজা ও মারাইনতং পাহাড়ের বুকে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্রমূলক সমাবেশের তীব্র নিন্দা জানাই। একই সাথে ধর্মকে ঢালসরূপ ব্যবহারকারী উ:উইচারা ভিক্ষু ও ২৮৭নং তৈন মৌজার হেডম্যান মংক্যনু মার্মাগংদের বিরুদ্ধে উস্কাকানি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”

মানব বন্ধনে বক্তারা বলেন, তৈন মৌজা হেডম্যান প্রশাসনের অংশ হয়েও প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য রাখার বিষয়টি ধৃষ্টতার সামিল। দ্রুত সময়ে বিরোধীয় ভূমি ও মৌজা সীমানা পরিচিহ্নিত করে বিরোধ নিস্পত্তি করে দেয়ার জন্য সাঙ্গু মৌজার ম্রো জনগোষ্ঠী প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।

বক্তব্য রাখেন, সাঙ্গু মৌজার হেডম্যান চংপাত ম্রো, বাংলাদেশ ম্রো ছাত্র সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি তনয়া ম্রো, কাইনপ্রে ম্রো, মুক্তারাম ত্রিপুরা কারবারী, ফলেং ম্রো, সাকতাই ম্রো, নাকি ম্রো, খাদিং ম্রো সহ অনেকে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন